কিছুদিন আগে বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম, এক পর্যায়ে বললাম, আমার না মন কেমন উদাস উদাস লাগে। কিছু ভালো লাগে না। সে উত্তর দিল, এ আর নতুন কী! প্রায়ই তো বলো। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলাম। আসলেই তো প্রায়শই হচ্ছে এমন কিছুই ভালো লাগে না। এতো চিন্তা,এ তো প্রেসার! তবুও মনে মনে ঠিক করি আর কাউকেই বলবো না এমন কথা। এমনিতেই আমি ইন্ট্রোভার্ট সুতরাং সমস্যা তো নাই।
মিথ্যে বলাটা স্বভাববিরুদ্ধ বলেই মন খারাপের সময় ‘ কেমন আছেন’? প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাই। অনেকদিন পর এক শুভাকাঙ্ক্ষী ম্যাসেজ দিল, কেমন আছো? লিখলাম, ডিপ্রেসড। তিনি জবাব দিলেন, কত সহজেই বললে!এ ইজন্যই তোমারে ভালো লাগে। এতে সহজিয়ার কী আছে বা ভালো লাগার কী আছে, তখন বুঝলাম না। কিন্তুএ কটু খেয়াল করতেই পারিপার্শ্বিকতায় দেখলাম, কেউ খারাপ আছি বা আমার মন খারাপ লাগছে এই কথাগুলোস হজে বলে না বা বললেও সেটার রিএক্ট নেগেটিভ আসে।
আপনি যখন কাউকে বলবেন, খারাপ লাগছে তখন শুরু হবেহা জারও প্রশ্ন। স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে সমস্যা চলছে বুঝি?ফি নানশিয়াল ক্রাইসিস? বাচ্চাকে নিয়ে সমস্যা? এমনস ব গোয়েন্দা মার্কা প্রশ্নে আপনার আরও দ্বিগুণ মন খারাপ হতে বাধ্য।
একবার হুমায়ূন আহমেদ শাওনকে লিখেছিলেন, শাওন! আমার খুব খারাপ লাগছে তুমি কি আমার মন ভালো করে দিতে পারবে? সেই প্রসঙ্গ টেনেই প্রবাসী বন্ধুটি লিখলো, আজ আমার হুমায়ূন আহমেদের মতো করেই কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি আমার মন ভালোকরে দিতে পারবে? উত্তর দিলাম, হয় এমন আমারও। আসলে আমাদের অনেকেরই এমন হয়।
কোনো এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা এসে যদি মনটাভা লো করে দিত! তবে এই বিষন্ন সন্ধ্যাগুলো গোধূলিরর ঙিন আলোর স্পর্শে অনিন্দ্য সুন্দর হতো। মুহূর্তেরহি সেবের জীবনে আরও কিছু রঙিন স্মৃতি জমা হতো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবে আসে না। তাই আমাদের মন ভালো করার দায়িত্বটা কাউকে দিতে পারি না। নিজেকেই নিজের ভালো রাখতে হয় এবং হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)
গবেষণায় দেখা গেছে, এই ঢাকা শহরের শতকরা ৭১ ভাগ মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে। সন্দেহ নেই অবস্থাটা ভয়াবহ। বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন এক নীরব ঘাতক। তিলে তিলে শেষ করে দেয় মানুষকে। গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে,আয়ের বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এই শহরে ধনী-দরিদ্রে এই বিশাল পার্থক্য প্রভাব ফেলছে নাগরিকদের মন এবং শরীরে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ১০ শতাংশ ধনী মানুষের আয় পুরো শহরের বাসিন্দাদের মোট আয়ের ৪৪ শতাংশ। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ১শতাংশের কম। রাজধানীর সাড়ে ৩ শতাংশ মানুষ এখনো তিন বেলা খেতে পায় না বলেও উঠে এসেছে গবেষণায়।
গবেষণা ছাড়াই আমরা নিত্যকার যাপিত জীবনেই তো টের পাচ্ছি এই অবস্থার সত্যতা। ক্রমবর্ধমান বাড়িভাড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভেঙে পরা ট্রাফিক সিস্টেমে নাভিশ্বাস এর মধ্যে বুক ভরে নিচ্ছি দুষিত বাতাস!
একটা মানুষ অফিসে যাবে, ৩০ মিনিটের পথ যেতে লাগছে দেড়-দুই ঘন্টা। অফিসে কাজের প্রেসার এবং সেই তুলনায় কাঙ্ক্ষিত বেতন কয়জন পাচ্ছে? বাসা ভাড়া,বাজার খরচ, আত্মীয়-স্বজনের সামাজিক আয়োজন,বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ এতো চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরে কে কার মনের খবর রাখে! ক্লান্ত শরীর অবসন্ন মন তবুও নিত্যকার অভিনয়, এই বেশ ভালো আছি।
মন খারাপ মানেই বিষন্নতা নয়। কিছু মন খারাপ সাময়িক। ক্ষণিক সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়।
আপনি বিষন্নতায় ভুগছেন কিনা বুঝবেন যেভাবে:
১. দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা।
২. যেসব কাজে আনন্দ পেতেন সেসব কাজে আনন্দ ও
আগ্রহ কমে যাওয়া।
৩. ঘুম অস্বাভাবিক কম বা বাড়তে পারে।
৪. খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।
৫. কাজে ও চিন্তায় ধীরগতি হয়ে যাওয়া নিজেকে নিয়ে
নেতিবাচক চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া
সবকিছুতে।
৬. সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব
তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা পরিকল্পনা ও চেষ্টা করে
কেন হয়:
১. মানসিক বা শারীরিকভাবে অবমাননার শিকার হলে
অপমানবোধ থেকে অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায়
আক্রান্ত হয়।
২. নিরাপত্তাহীনতা বা একাকিত্ব।
৩. ব্রেকাপ, ডিভোর্স বা কাছের কোন স্বজনের মৃত্যুর
শোক।
৪. বংশগত প্রভাব
৫. জীবন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন অর্থাৎ চাকরি
হারালে, অবসরে গেলে, আয় কমে গেলে, জায়গা
পরিবর্তন করলে অনেকে ডিপ্রেশনে ভুগতে পারেন।
৬. বড় কোনো রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
প্রতিরোধের উপায়:
১. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
২. সুষম খাবার গ্রহন।
৩. নিয়মিত ঘুম।
৪. ব্যায়াম
৫. নিজেকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করা।
৬. ইতিবাচক চিন্তা
৭. উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে কাজ করা।
৮. পরিবার, বন্ধু, প্রিয়জনের সাথে আনন্দঘন সময়
কাটানো।
৯. চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে বড় সংকটের তৈরি করতে যাচ্ছে এই বিষণ্ণতা। বিষন্নতা আক্রান্তদের শতকরা ১৫ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকেন। বিষন্নতা গোপন করার কিছু নেই। কথা বলুন মন খুলে। মনোযোগী হোন প্রিয়জনের প্রতি। ডিপ্রেশন কাটাতে কাউকে সাহায্য করতে না পারলেও তাকে আরো ডিপ্রেসড না করি।
আপনার ডিপ্রেশন আপনার খারাপ লাগা বের হবার চেষ্টা করতে হবে আপনাকেই। এক্ষেত্রে কাউকে পাশে পেয়ে গেলে বের হওয়াটা সহজ হয়। যদি পাশে কাউকে না পাওয়া যায় তবে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’ নীতিতে নিজেই সাহায্য করুন নিজেকে। নিজের প্রতি ইতিবাচক ভাবনার কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক পরিশ্রম তথা ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। সর্বোপরি ভালোবাসুন নিজেকে। জীবন একবারই। চেষ্টা করুন অপার আনন্দে ভরিয়ে তুলতে। খুব বেশি খরচের দরকার হয় না তাতে। সুখটা সম্পূর্ণই মানসিক ব্যাপার। নিজের মতো ভালো থাকাটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এ জীবনে।
Leave a Comment