একজন নভোচারী হতে কী কী যোগ্যতা লাগে? একজন নভোচারী কী কী সমস্যায় ভুগেন? একজন নভোচারী কত টাকা বেতন পায় | What are the qualifications to be an astronaut?  What problems does an astronaut suffer from?  How much does an astronaut get paid?


তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ হয়তো তার ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে করেন। কেউ বা মনে করেন তার হারিয়ে যাওয়া স্বজনের কথা; ভাবেন তার প্রিয় মানুষটি মৃত্যুর পরে ঐ আকাশের তারা হয়ে গেছেন।

কোন মা হয়তো চাঁদ মামাকে ডেকে তার সোনা
জাদুমণির কপালে টিপ দিয়ে যেতে বলেন; আবার
কোন কোন মা তার খোকন সোনাকে শুনান চাঁদের বুড়ির গল্প। কোন কবি হয়তো চাঁদকে ঝলসানো রুটির সাথে তুলনা করেন, চাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেন একের পর এক কাব্য!! আবার এমনও কিছু মানুষ আছেন যারা চাঁদের আলোতে একা একা হাঁটতে পছন্দ করেন কিংবা চাঁদনী রাতে সমুদ্রের পারে তার প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে ভালবাসেন।

কিন্তু আমি আজ তাদের কারো কথাই বলতে আসিনি; আমি এসেছি তাদের জন্যে লিখতে যারা চোখ বন্ধ করলেই চাঁদকে দেখতে পায়, তারাভরা আকাশ ভেসে উঠে তাদের চোখের সামনে; যারা চোখ বন্ধ করলেই দেখে চাঁদে লাফাচ্ছে, নীল আর্মস্ট্রঙের সাথে কথা বলছে কিংবা মঙ্গলে অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে, মিতালী পাতাচ্ছে ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে।

বুঝতে পেরেছ আমি কাদের কথা বলছি?? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ; আমি তাদের কথাই বলছি যারা ‘নভোচারী’ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যারা নিজের দেশের পতাকা উড়াতে চায় সবচেয়ে উঁচুতে; যারা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকে জয় করবার দৃঢ় সংকল্প করে মনে মনে।

তবে চল দেরি না করে জেনে নেয়া যাক কি করতে
হয় নভোচারী হতে হলে, কি ধরণের যোগ্যতা দরকার পরে নভোচারী হওয়ার জন্যে কিংবা কেমন নভোচারীদের জীবন, মহাশুন্যে কিভাবে কাটে তাদের সময়, কি খায় তারা মহাশুন্যে, কিভাবে ঘুমায়... এরকম সব প্রশ্নের উত্তর।

নভোচারী মানে কি?
‘নভোচারী’ শব্দটি হলো ইংরেজি শব্দ ‘Astronaut’ এর বাংলা রূপ। আবার ‘Astronaut’ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘তারার নাবিক (Star Sailor)’। রাশিয়ায় নভোচারীদেরকে বলা হয় ‘Cosmonaut’। আর স্বাভাবিকভাবেই নভোচারীদেরকে আমরা তারার নাবিক বলতেই পারি। কারণ তারার দেশেই তাদের সমস্ত কাজ, একটা জাহাজে (Spaceship) করে ভেসে গিয়ে ওখানেই তাদের গবেষণা করতে হয়। তারার
দেশে গিয়ে তারা সরেজমিনে দেখে আসেন ওই
এলাকাটা। নিয়ে আসেন ওখানকার তামাম খবরাখবর।

নভোচারী হওয়ার যোগ্যতা
২০১১ এর জুন মাস পর্যন্ত ৩৮ টি দেশের মোট ৬৫৪ জন ভাগ্যবান মানুষ মহাশুন্যে যেতে পেরেছেন। নভোচারী হতে বেসামরিক কিংবা সামরিক ব্যক্তি যে কেউ আবেদন করতে পারেন। তবে আবেদন করতে কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। নিচে একে একে সেগুলো বর্ণনা করা হলো:

একজন নভোচারীর শারীরিক যোগ্যতা
উচ্চতা : ৬২ থেকে ৭৫ ইঞ্চি।
দৃষ্টিশক্তি : কাছের এবং দূরের জিনিস চিহ্নিতকরণে দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি ২০/২০। (ভুলের মাত্রা ২০/২০০ কিংবা তার চেয়ে ভালো হলেও যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। )
রক্তচাপ: বসা অবস্থায় ১৪০/৯০।
একজন নভোচারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা
কোন প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল,
জীববিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান কিংবা গণিতে অন্তত তিন বছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রি। তবে ১ বছর মেয়াদী মাস্টার্স কিংবা ৩ বছর মেয়াদী ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রিধারীরা অগ্রাধিকার পাবেন। তাছাড়া আরো অগ্রাধিকার পাবেন দ্বাদশ শ্রেণী অব্দি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রার্থীরা।
নভোচারীদের অন্যান্য যোগ্যতা
১) অন্তত ১০০০ ঘণ্টা জেট প্ল্যান চালানোর
অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
২) আবেদনকারীকে ‘International Astronomical Union’ এর সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয়
১) নভোচারী নির্বাচনে শারীরিক যোগ্যতা ও বয়স
বিবেচ্য নয়।
২) বৈবাহিক অবস্থা বিবেচ্য নয়।
৩) ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বিবেচ্য নয়।

একজন নভেচারী নির্বাচন প্রক্রিয়া
বেসামরিক এবং সামরিক সকল প্রার্থীদেরকে সপ্তাহব্যাপী একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যেখানে তাদেরকে পার্সোনাল ইন্টারভিও, মেডিকেল পরীক্ষা, ওরিয়েন্টেশানের মুখোমুখি হতে হয়।

নভোচারীদের প্রশিক্ষণ
নির্বাচিত আবেদনকারীরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হোন। (নাসার ক্ষেত্রে সেটা টেক্সাসের হাস্টনে অবস্থিত জনসন স্পেস
স্টেশানের এস্ট্রোনট অফিস। ) তারপর চলে টানা ২ বছর ব্যাপী প্রশিক্ষণ। এতে শিখানো হয় স্পেস
এক্সপ্লোরেশান মিশনের কুটিনাটি থেকে শুরু করে
সবকিছু। আর অন্যদিকে সামরিক প্রার্থীরা নাসা’র
এয়ারক্র্যাফট দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাকে ঝালাই
করতে থাকেন।

প্রশিক্ষণ শুরুর প্রথম মাসেই প্রার্থীদেরকে সাতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ফ্লাইং সিলেবাস শুরু করার আগেই তাদের সুইমিং সিলাবাস শেষ করতে হয়। সেই সাথে স্পেস ওয়াক ট্রেনিংয়ের জন্যে তাদেরকে SCUBA কোয়ালিফাইড হতে হয়। SCUBA হচ্ছে কম্প্রেসড বাতাসের মজুদ সাথে নিয়ে পানির নিচে সাতার কাটা। প্রার্থীদেরকে ২৫ মিটার লম্বা পুল  একেবারে না থেমেই ৩ বার সাঁতরে অতিক্রম করতে হয়।
তারপর তাদেরকে ঠিক এই কাজটাই স্পেসস্যুট আর টেনিস সুট পড়ে আবারও করতে হয়; তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কাজটি শেষ করার জন্যে কোন নির্ধারিত সময় বেঁধে দেওয়া হয় না। প্রার্থীদেরকে একটি উঁচু চেম্বারে উচ্চ এবং নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় চাপের মুখোমুখি করা হয় যাতে তারা এ ধরণের
পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর ব্যাপারে ধারণা
নিতে পারেন এবং মিশনে তা কাজে লাগাতে পারে।

তারপর একটি জেট এয়ারক্র্যাফটে কৃত্রিম ওজনহীনতা সৃষ্টি করে তাদেরকে সেটি অনুভব করানো হয়, যার স্থায়িত্ব হয় প্রায় ২০ সেকেণ্ড
এবং ২০ সেকেণ্ড করে করে এই প্রক্রিয়াটি প্রতিদিন ৪০ বারের মত করে চলতে থাকে। তবে
জিরো জি ফ্লাইটে নভোচারীদের প্রকৃত ওজনহীনতাও অনুভব করানো হয়।

নভোচারীদের জিরো জি ফ্লাইটে প্রশিক্ষণ
আর সবার মধ্য থেকে স্পেস মিশনের জন্যে
নভোচারী নির্বাচনটা আসলে এই পরীক্ষা কিংবা
ট্রেনিংগুলোর সফল সমাপ্তির উপরে ভিত্তি করেই
করা হয়। অবশ্য International Space Station systems training, Extravehicular Activity skills training, Russian Language training, Robotics skills training আর Aircraft Flight readiness training –এর মত আরো কিছু ট্রেনিংয়ের সফল সমাপ্তির প্রয়োজন পড়ে
চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্যে। যেসকল
বেসামরিক প্রার্থীরা নভোচারী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন না তারা আসন খালি থাকা সাপেক্ষে যোগ্যতানুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান।

নভোচারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ
চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর নভোচারীদেরকে
সবচেয়ে কঠিন প্রশিক্ষণের মুখোমুখি হতে হয়।
স্পেসক্র্যাফট ট্রেইনাররা তাদেরকে স্পেসক্র্যাফট
চালানো থেকে শুরু করে Aircraft Systems- এর প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় শিখিয়ে দেন, যাতে মিশনে
যেকোনো ধরণের সমস্যাকে তারা বুড়ো আঙুল
দেখাতে পারেন। তাছাড়া তাদেরকে বারবার করে কৃত্রিমভাবে তৈরি ওজনহীনতা অনুভব করানো হয়। কিভাবে ঘুমাতে হবে অভিযানের সময়, কি খেতে হবে, কিভাবে খেতে হবে, কিভাবে কি করতে হবে সব, সবকিছুর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আবার তাদেরকে ডিজাইন করা, সেটা পরীক্ষা করা, ডিজাইনটির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কিভাবে ক্যামেরা চালাতে হয় তাও শেখানো হয়।
আর পাইলট নভোচারীদের প্রতি মাসে ১৫ ঘণ্টা আর অন্যদিকে নন-পাইলট নভোচারীদের ৪ ঘণ্টা করে জেট প্ল্যান চালাতে হয়। তবে সকল প্রশিক্ষণ
সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করা মানেই কিন্তু মহাকাশে
যাবার সুযোগ পেয়ে যাওয়া নয়। মহাকাশে যেতে হলে নতুন মিশনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় এবং কখনো কখনো সেই অপেক্ষার পাল্লাটা বেশ ভারীই হয়ে যায়। হতে পারে সেটা ১ বছর, ২ বছর, ৫ বছর কিংবা আরো বেশি। তবে ভাগ্য ভালো হলে সেই সুযোগটা আপনি এক মাসেও পেতে
পারেন।

নভোচারীদের দায়িত্ব
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের সব কাজেরই
দায়িত্ব থাকে নভোচারীদের উপর। পাইলট
নভোচারীদের দায়িত্ব হল মহাকাশযানকে সুচারুরূপে চালানো। মিশন কমান্ডারের দায়িত্ব হল সবার কাজ তদারকি করা এবং তিনিই অভিযানের সাফল্য, ব্যর্থতা, নিরাপত্তা সব কিছুর জন্যে দায়ী থাকেন।

আর অন্যদিকে মিশন স্পেশালিষ্টরা যন্ত্রপাতি মেরামত, নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং এই
ধরণের কাজ করে থাকেন। মিশন স্পেশালিষ্টদেরকে সাধারণত প্রকৌশলী, ফিজিশিয়ান এবং বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। তাদের এই কাজকে
অফিসিয়ালি বলা হয় Extravehicular Activity বা সংক্ষেপে EVA, যাকে আমরা বলে থাকি স্পেস
ওয়াক। ১৯৯৮ থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অবস্থানরত নভোচারীরা প্রায় ১০০০ ঘণ্টা স্পেস ওয়াক সম্পন্ন করেছেন। তবে স্পেসশিপকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও তাদের দায়িত্ব।

নভোচারীদের স্পেসস্যুট
স্পেসস্যুট হচ্ছে নভোচারীদের বিশেষ ধরণের
পোশাক, যা তাদেরকে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর
মহাজাগতিক রেডিয়েশন থেকে বাঁচায়। একটি
স্পেসস্যুটের গড় মূল্য ১২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৯ কোটি ৯৬ লাখ!
স্পেসস্যুট নভোচারীকে -১২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস(-২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মত ঠাণ্ডা থেকে এবং ১২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস(২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর মত তীব্র গরম থেকে বাঁচাতে পারে। এদের একেকটির ওজন ১২৭ কিলোগ্রাম করে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আগামী ১৫ বছরে
নাসার যেখানে বড় জোর ৪৪ টি স্পেসস্যুট বব্যবহার করার সম্ভাবনা আছে সেখান এক অ্যাপোলোর ১৭ টি মিশনেই ২০১ টি স্পেসস্যুটের প্রয়োজন পড়েছিলো! এর আরেকটি বড় সুবিধা হলো স্পেসস্যুট পরিহিত অবস্থায় মহাকাশযানের বাইরে অবস্থানকালে নভোচারীরা সরাসরি মূত্রত্যাগ করতে পারেন; আর স্পেসস্যুটটি যেহেতু অক্সিজেন ভর্তি থাকে সেহেতু নভোচারীর শ্বাসপ্রশ্বাসেও কোন সমস্যা হয় না।


মহাশুন্যে নভোচারীদের জীবনযাত্রা
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতি ঘণ্টায় প্রায়
২৭০০০ কিলোমিটার (১৭০০০ মাইল) বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। যার ফলে সেখানে অবস্থানরত নভোচারীরা প্রতি ৯০ মিনিটে একবার করে সূর্যোদয় দেখতে পান। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় তারা ১৬ টি সূর্যোদয় উপভোগ করেন! কাজের সময়কে ঠিক রাখার জন্যে নাসার নভোচারীরা
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে রাখা ঘড়িটি মেনে চলেন যেটি আসলে টেক্সাসের হাস্টন এবং রাশিয়ার মধ্যবর্তী মোট দূরত্বের মাঝামাঝি
স্থানের গ্রিনিচ মান সময়ানুযায়ী চলে। আর পৃথিবীর মতই তারা ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত কাজ করেন। তবে মহাকাশযানে থাকা অবস্থায় নিরাপত্তার খাতিরে পুরো ব্যাপারটাই কিছুটা উলটপালট হতে পারে।

মহাশুন্যে নভোচারীরা ঘুমানোর জন্যে একধরণের
স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করে থাকেন। মজার ব্যাপার
হল স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার পর সেটি শুন্যে ভাসতে
থাকে। তাই নভোচারীরা ব্যাগটিকে কোন কিছুর
সাথে বেঁধে রাখেন।


তবে এক ধরণের বেঁধে রাখা বিছানায়ও তারা ঘুমান। সেক্ষেত্রে আবার বিছানার সাথে তাদের
নিজেদেরকেও বেঁধে রাখতে হয়। নাহলে ঘুমানোর
পরে পুরো মডিউল জোরে তারা ভাসতে থাকবেন।
তবে মহাকাশযানে কমান্ডার কিংবা পাইলটরা
নিজেদের সিটেও ঘুমাতে পারেন। তবে যেহেতু প্রতি ৯০ মিনিট পরপর সূর্য উঠে সেহেতু ককপিটে ঘুমানো মোটেই ভালো কোন সিদ্ধান্ত নয়। কেননা ককপিটের জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো ঘুম ভাঙানোর জন্যে যথেষ্ট; যদি না ঘুমন্ত ব্যক্তিটি স্লিপ মাস্ক না পড়ে থাকেন।

সাধারণত নভোচারীরা মহাকাশে অবস্থানরত
অবস্থায় প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার মত ঘুমান। ঘুমের মধ্যে
তারা স্বপ্নও দেখেন। অনেকে আবার নাকও ডাকেন। নাসার নভোচারীদের জন্যে অবশ্য হাস্টনে অবস্থিত মিশন কন্ট্রোল সেন্টার প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার সময় হলে নভোচারীদের পছন্দানুযায়ী গান পাঠিয়ে তাদের জাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। গানটা হতে পারে রক অ্যান্ড রোল, দেশাত্মবোধক, ক্লাসিক্যাল, ওয়েস্টার্ন কিংবা রাশিয়ান কোন গান।

আর গোসল? শুনতে অবাক লাগলেও নভোচারীরা মহাশুন্যে অবস্থানরত সময়ে একবারের জন্যেও গোসল করেন না। আসলে মাধ্যাকর্ষণ বল না থাকায় তারা গোসল করতে পারেন না। রাশিয়ান কসমোনট Sergei K. Krikalev মোটমাট ৮০৩ দিন ৯ ঘণ্টা ৩৯ মিনিট
অর্থাৎ প্রায় ২.২ বছর মহাশুন্যে কাটিয়েছেন। ভাবতে পারছেন যে এই দীর্ঘ সময়ে একবারের জন্যেও তিনি গোসল করেন নি!!

তবে হ্যাঁ, নভোচারীরা মাথায় শ্যাম্পু করেন!!
বিশেষভাবে তৈরি এক ধরণের শ্যাম্পু তারা ব্যবহার করেন এবং মাথা ধোয়ার জন্যে রীতিমত এক ধরণের বন্দুক ব্যবহার করেন, যা দিয়ে দ্রুতবেগে পানি ছোড়া হয়। আর তাছাড়া প্রত্যেকের জন্যে আলাদা টুথ ব্রাশ, টুথ পেস্ট, রেজার, টাওয়ায়েল থাকে। এবার আসা যাক টয়লেটের ব্যাপারে। জিরো গ্রেভিটিতে কিভাবে নভোচারীরা ত্যাগের সুখ লাভ করেন? এমন প্রশ্ন আপনাকে ভাবাতেই পারে। তারা প্রাকৃতিক কাজ করার জন্য রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের তৈরি মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার মুল্যের একধরণের টয়লেট ব্যবহার করেন। যেখানে বিশেষভাবে তৈরি পাখা এবং পাইপ লাগানো থাকে! অবশ্য স্পেসস্যুটের ভেতরেও ২ লিটার পর্যন্ত তরল রাখার ব্যবস্থা করা থাকে।

সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো মহাশুন্যে জিরো
জি’তেও নভোচারীদের শারীরিক বৃদ্ধি ঘটে। এই
বৃদ্ধির পরিমাণ প্রতি মাসে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে
পারে। যখন তাদের কোন কাজ থাকে না তখন তারা সহকর্মীদের সাথে গল্প-গুজব করে, বই পড়ে, মুভি দেখে কিংবা পৃথিবীতে থাকা স্বজনদের সাথে
কথা বলে সময় কাটান। নভোচারীদেরকে সুস্থ থাকার জন্যে যথেষ্ট ব্যয়াম করতে হয়। অবসর সময়ে অনেকেই তাই এক্সারসাইজ বাইকে চড়েও ঘাম ঝরান।


নভোচারীদের খাবার-দাবার
মহাশুন্যে নভোচারীদের কি খাবার দেওয়া হবে
সেটা ঠিক করা হয় বেশ কিছ কিছু নিয়ম কানুনের উপর ভিত্তি করে। খেয়াল রাখা হয় খাবারগুলো যেন হালকা, পুষ্টিকর, সহজে হজমযোগ্য এবং সুস্বাদু হয়।

প্রধানত ফল এবং শাকসবজিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই যেমন আপেল, বাদাম, টমেটু, সালাদ প্রভৃতি। বিভিন্ন ধরণের ফলের রসও গুরুত্ব পায়। তবে মিশন শুরু হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই তাদেরকে এইসব তাজা শাকসবজি এবং তাজা ফলমূল খেয়ে ফেলতে হয়। নভোচারীদের পছন্দের উপর ভিত্তি করে বেশ অনেক ধরণের খাবারই প্রক্রিয়াজাত করে দেয়া হয় তাদের।
কথিত আছে যে নভোচারীদেরকে প্রায় ৭০ ধরণের খাবারের একটা মেনু দেয়া যেখান থাকে তাদের পছন্দের খাবারগুলো নির্বাচন করতে হয়। এশিয়ান নভোচারীরা ভাত, গরুর মাংস, মুরগীর মাংস, চাও খেয়ে থাকেন মহাশুন্য অভিযানের সময়। চিংড়ী মাছ, রুটি, বার্গার, পাস্তা এবং
নভোচারীদের জন্মস্থান এবং খাদ্যাভ্যাসের উপর
ভিত্তি করে অঞ্চলভিত্তিক খাদ্যগুলো ঠাই পায়
তাদের খাদ্যতালিকায়।

তবে যে খাবারই খাওয়া হোক না কেনো,
ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচতে খাওয়ার আগে
অবশ্যই সেটিকে গরম করে নিতে হয়। বিভিন্ন খাবার খেতে নভোচারীদেরকে প্রায়ই এমনকিছু ধাতব টিউব ব্যবহার করতে হয়, যেগুলোর ওজন প্রায়শই সংশ্লিষ্ট খাবারটির চেয়েও বেশি হয়। তারা ধাতব চামচও ব্যবহার করে থাকেন।

বিভিন্ন সময় কার্বনেটেড পানীয়কেও মহাশুন্যে
নভোচারীদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।
কোকাকোলা, পেপসি কিংবা বিয়ার কোনটাই
আসলে মহাশুন্যে ততটা সুবিধা করতে পারে নি।
কারণ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছাড়া নভোচারীদের
পাকস্থলীতে এই পানীয়গুলো থেকে তরল এবং গ্যাস আলাদা করা যায় না, যা তাদের জন্যে মোটেই ভালো কিছু নয়।


নভোচারীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হোন
মহাশুন্যে নভোচারীদেরকে বেশ কিছু সমস্যার
মোকাবেলা করতে হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির
অনুপস্থিতির কারণে তাদের মাথা ব্যথা থেকে শুরু
করে বমি হওয়া, খাওয়ায় অরুচি পর্যন্ত হতে পারে। অনেকেই কখনো বা অনুভব করেন যেন তাদের চোখের মণিতে কোন সাবঅ্যাটমিক বুলেট এসে বিঁধছে। কেউ কেউ আবার অনুভব করেন যে তাদের চোখ থেকে অস্বাভাবিকভাবে আলোর ঝলকানি বের হচ্ছে। এর কোনটাই কিন্তু মানুষের চোখের জন্যে ভালো নয়। অন্তত ৩৯ জন নভোচারী মিশনের পরে চোখের সমস্যায় ভুগেছেন।

মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুপস্থিতির কারণে ব্যপারটা
মাঝেমাঝে এরকম হয় যে নভোচারীদের মধ্যে কেউ কেউ অনুভব করতে থাকেন যে তার শরীরটা সামনের দিকে ঝুকে আছে; নিজের হাত-পা ঠিক কোথায় আছে তাও তিনি ঠিকমতো অনুভব করতে পারেন না। এই সমস্যায় প্রায় অর্ধেক নভোচারীরাই ভুগেন; একে বলা হয় “Space Adaptation Syndrome”। ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত যে ৬৫৪ জন নভোচারী মহাশুন্যে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৩৯ জন মারা গেছেন। ৩৯ জনের মধ্যে ১৮ জন মারা গেছেন মিশন চলা অবস্থায় দূর্ঘটনায় এবং বাকি ১১ জন মারা গেছেন
ট্রেনিঙের সময় দূর্ঘটনায়। তাছাড়া মহাশুন্য থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসা নভোচারীদেরকে বেশ কিছু মধুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তারা মহাশুন্য এবং পৃথিবীর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। এই যেমন কেউ কেউ কয়েক মাস ধরে বারবার চায়ের কাপ হাত থেকে ফেলে দেন, আবার কেউ বা বেশ উঁচুতে রাখা কোন জিনিস অনায়াসে ধরে ফেলবার চেষ্টা করেন!!



একজন নভোচারী কতটাকা বেতন পায়
* একজন লেভেল ১ এর নভোচারী (Trainee Astronaut) প্রতি বছর বেতন হিসেবে পান সর্বনিম্ন ৮৩০০০ থেকে ৯২০০০ ইউএস ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় ৬৯ লাখ থেকে ৭৬ লাখ।
* একজন লেভেল ২ এর নভোচারী (Working Astronaut) প্রতি বছর বেতন হিসেবে পান সর্বনিম্ন ৯২০০০ থেকে ১১৪০০০ ইউএস ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় ৭৬ লাখ থেকে ৯৫ লাখ।
* একজন লেভেল ৩ এর নভোচারী (Senior Astronaut) প্রতি বছর বেতন হিসেবে পান সর্বনিম্ন ১১৪০০০ থেকে ১৬৩০০০ ইউএস ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি ৩৫ লাখ। তবে আমার মনে হয় তোমরা যারা নভোচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখ- ওজনহীনতা অনুভব করবার স্বপ্ন দেখ, ভিনগ্রহে প্রাণের রহস্য উদঘাটনের স্বপ্ন দেখ, মাথার উপরের বিশাল আকাশকে জয় করবার স্বপ্ন দেখ, সবার উপরে দেশের পতাকাকে তুলে ধরবার স্বপ্ন দেখ তাদের কাছে এই বিশাল অংকের টাকাটা মোটেই মুখ্য নয়। বরং মুখ্য তোমাদের স্বপ্ন, তোমাদের স্পৃহা আর তোমাদের দেশপ্রেম।

তথ্যসূত্র :
১) www.nasa.gov
২) www.esa.int
৩) www.wikipedia.org

Leave a Comment